মেহেরপুর প্রতিনিধি-এম.সোহেল রানা:
করোনা ভাইরাস (কোভিড-১৯) এর কারণে প্রায় দেড় বছর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ থাকায় লাখ লাখ শিক্ষার্থীর যে ক্ষতি হয়েছে, তা অপূরণীয়। আর্থসামাজিক কারণে অনেক শিক্ষার্থীর শিক্ষাজীবন অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। কীভাবে এই ক্ষতি পূরণ করা যাবে, তা এখন বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
করোনা ভাইরাস (কোভিড-১৯) এই মহামারীর নি-দারুন করুন ছবলের প্রভাবে বাংলাদেশসহ সারা বিশ্ব আজ স্তব্ধ প্রায়, স্থবির হয়ে পড়েছে জীবন যাত্রার মান। মানবের জীবন-জীবিকায় মহা-আকাল ধারণের সন্ধ্যিক্ষণের উপক্রম প্রায়। রাষ্ট্রের সকল পর্যায়ের সেক্টরে করোনা ভাইরাস (কোভিড-১৯)-এর প্রভাব ফেলেছে তবুও স্বল্প পরিষরে হলেও অন্যান্য সেক্টরের কার্যক্রমগুলো চালু করা হয়েছে বা চলছে। যেখানে শিক্ষায় জাতির মেরুদন্ড সেখানে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে বাকি সব প্রতিষ্ঠান চলমান থাকবে এটা কেমন আইন বা আইনের শাসন প্রতিফলিত হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়, স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা ও মেডিকেল কলেজের বিধি নিষেধের ক্ষেত্রে যেটা হওয়া উচিৎ ছিল- “সবার শেষে বন্ধ হবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং খোলার ক্ষেত্রে সর্বাগ্যে খুলতে হবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান” কিন্তু সেটা না হয়ে লকডাউন উঠলেও সকল প্রতিষ্ঠান চলছে কিন্তু বন্ধ থাকছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো- তাই বিশেষ করে শিক্ষা ব্যবস্থা বাংলাদেশে আজ “হযবরল” অবস্থার আকার ধারণ করেছে বলে অনেকে মন্তব্য করেছেন।
দীর্ঘ দিন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকাতে শিক্ষার্থীরা “গোণ্ডি ছাড়া বাঁধন হারা” হয়ে গেছে। এখন না শুনছে অভিভাবকদের কথা আর শ্রদ্ধেয় বড়দের সম্মান করতে যেন ভুলতে বসেছে বর্তমান প্রযন্ম। তবে স্কুলে অ্যাসাইমেন্ট (নির্ধারিত কাজ) দেওয়াতে কিছু অভিভাবকসহ বিভিন্ন পেশার মানুষ হলেও একে অন্যের কাজ করে দিতে শিখেছে। প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক বিদ্যালয় পর্যায়ে অভিভাবদের মধ্যে পর্যবেক্ষণ করে দেখে গেছে বেশির ভাগই ১ম শ্রেণি থেকে ৩য় শ্রেনি পর্যন্ত স্কুল থেকে দেওয়া অ্যাসাইনমেন্ট এর কাজগুলো আদরের সন্তানদের শিক্ষার মান-উন্নয়ণ করার লক্ষ্যে- নিরলস ভাবে পরিশ্রম করে যাচ্ছে শিক্ষার্থীর কিছু কিছু অভিভাবকেরা। তারা অ্যাসাইনমেন্ট শীট পড়ে লিখে দেবার কাজ নিরবধি অধ্যাবসায় করে চলেছেন বাড়িতে। যে অভিভাবকেরা পড়া-লেখা জানেনা তারা বড় ছেলে-মেয়েদের দিয়ে লিখে নিচ্ছে। আবার অন্য দিকে লক্ষ্য করে দেখেছি ৪র্থ ও ৫ম শ্রেণি এবং ৬ষ্ঠ শ্রেণি থেকে ১০ম শ্রেণি পর্যন্ত এ শিক্ষার্থীরা অ্যাসাইমেন্ট পেলে অ্যাসাইনমেন্টের উত্তর শীট বিভিন্ন মাধ্যম থেকে সংগ্রহ বা ডাউনলোড করে তাদের ছোট ভাই-বোন অর্থাৎ যে যে শ্রেণিতে পড়া-লেখা করে তার নিচের শ্রেণিতে পড়া ছোট ভাই-বোনদেরকে দিয়ে অ্যাসাইনমেন্টের উত্তর লেখিয়ে নিচ্ছে। বই খুলে পড়ার প্রতি তাদের কোন আগ্রহ নেই, ফলে বেশির ভাগ শিক্ষার্থীরাই শুদ্ধ বানান ও উচ্চারণ করতে ভুলে গেছে, ভুলে গেছে দ্রুত পঠনাভ্যাস। এখন তারা বেশির ভাগ সময় কাটাচ্ছে অনলাইন ভিত্তিক সামাজিক মাধ্যম ও বিভিন্ন গেমস খেলে। যেমন- ফেসবুক, ইউটিউব, লাইকি, টিকটক, ফ্রি ফায়ার, পাবজি’র মত মহা-ক্ষতিকর খেলাতে আশক্ত হয়ে পড়েছে। এগুলো হয়েছে শুধু মাত্র শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার ফলে। এ অভিযোগগুলো এসেছে অভিভাবকদের পক্ষ থেকে। অ্যাসাইনমেন্টের এমন অবস্থা চলতে থাকলে শিক্ষা ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের মান-উন্নয়নে কি কাজ হবে, পড়া-লেখা না করে অন্যের সহায়তায় লিখে অটো পাশ শিক্ষিত জনপদ দিয়ে দেশের মঙ্গলজনক কি কাজ আশা করা যায় এটা জাতির কাছে প্রশ্ন রেখে গেলাম। বাংলাদেশে এমন অবস্থা চলকে থাকলে এক সময় শিক্ষার্থীরা শিক্ষা বিমুখ হয়ে পড়বে। এক পর্যায়ে শিক্ষার প্রতি মানুষের উদাসিনতার কারণে শিক্ষিত মানুষ কমতে থাকবে। মূর্খতার প্রভাব বাড়তে থাকবে। শিক্ষিত মানুষ হবে বা থাকবে কিন্তু অটো পাশ শিক্ষিত। সেই শিক্ষিত মানুষ দ্বারা জাতির কি সুফল ব’য়ে আনবে সেটা অনেক চিন্তার বিষয় হয়ে দাড়িয়েছে। যোগ্য স্থানে যোগ্য মানুষ ছাড়া যেমন যোগ্যের সুফল আশা করা যায় না তদ্রুপ শিক্ষা ছাড়া জাতি গঠণ করা যায়। কোন দেশ বা জাতির মেরুদন্ড ভাঙতে হলে আগে সেই জাতির শিক্ষাখাত নষ্ট করতে হবে। শিক্ষাখাত নষ্ট করতে পারলেই সেই জাতি বা দেশ ধ্বংশের দিকে অগ্রসর হবে। আমার যেন তাই মনে হচ্ছে – আমরা কি সেই পথেই অগ্রসর হচ্ছি? জাতির কাছে প্রশ্নটা রেখে গেলাম।
অনেক বিশেষজ্ঞ ও নীতিনির্ধারক মনে করেন, করোনা সংক্রমণের হার ৫ শতাংশের নিচে নামলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া যেতে পারে। বর্তমানে এই হার ২০ শতাংশের কাছাকাছি। কিছুদিন আগেও এটি ৩০ শতাংশের ওপরে ছিল। তবে সংক্রমণের হারের যথার্থতা নিয়ে বিতর্কও আছে। সংশ্লিষ্টদের মতে, বর্তমানে সংক্রমণের হার নির্ধারিত হচ্ছে করোনা উপসর্গ নিয়ে, যাঁরা হাসপাতাল বা ক্লিনিকে যান, তাঁদের পরীক্ষার ভিত্তিতে। দৈবচয়নের ভিত্তিতে পরীক্ষা করলে প্রকৃত সংখ্যা পাওয়া যেত। অতএব, সংক্রমণের হারের দোহাই দিয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখার কোনো যুক্তি নেই। এ সংক্রমণের মধ্যেই সরকার সবকিছু খুলে দিয়েছে। সমাজজীবনের সবকিছু স্বাভাবিক দেখানোর চেষ্টা আছে। তাহলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অস্বাভাবিকতা আর কত দিন চলবে? সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, ৩১ আগস্ট পর্যন্ত সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে। এরপর পর্যায়ক্রমে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়াই সমীচীন হবে। বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো খোলার প্রস্তুতি এখনই নিতে হবে। এরপর উচ্চমাধ্যমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয় খুলে দিতে হবে। সবশেষে প্রাথমিক বিদ্যালয়। সরকার আগামী নভেম্বরে এসএসসি ও ডিসেম্বরে এইচএসসি পরীক্ষা নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। হাতে সময় আছে মাত্র দু-তিন মাস। সেপ্টেম্বরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে না দিলে তা সম্ভব হবে না। তাই আর বিলম্ব না করে এখনই প্রস্তুতি নিন। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে উচ্চমাধ্যমিক ও মাধ্যমিক পর্যন্ত কত শিক্ষার্থীকে কত দিনে টিকা দেওয়া যাবে, সে সম্পর্কে একটি রূপরেখা তৈরি করুন। শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার পরামর্শ দেওয়ার পাশাপাশি এর উপকরণও সরবরাহ করতে হবে। গত দেড় বছরে শিক্ষার বিরাট ক্ষতি হয়েছে। এ ক্ষতি বাড়তে দেওয়া ঠিক হবে না।
তাই সরকারের নিকট আবেদন অতিসত্তর যেন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো স্বাস্থ্য বিধি মেনে খুলে দেওয়ার সকল ব্যবস্থা গ্রহণ করেন।
রচনাকালঃ ২১আগস্ট-২১ইং, মেহেরপুর।
লেখকঃ এম.সোহেল রানা, স্নাতকোত্তর (রাষ্ট্র বিজ্ঞান), কুষ্টিয়া সরকারি কলেজ, কুষ্টিয়া।